বেপরোয়া এজেন্ট ব্যাংকিং, গ্রাহকের সঞ্চয় নিয়ে লাপাত্তা
ঘটনাটি কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর থানার বোর্ডবাজার এলাকার। ডাচ-বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট আলমগীর কারও ২ লাখ, কারও ৫ লাখ টাকা করে সাধারণ গ্রাহকদের প্রায় ২০ কোটি টাকা গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে জমা না দিয়ে লাপাত্তা। তিনি গ্রাহকদের ব্যাংকের ভুয়া ভাউচার দিয়ে টাকা নিলেও গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দেননি।
জানা গেছে, আলমগীর স্থানীয় গ্রাহকদের ভালো লাভ পাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে সঞ্চয় করতে বলেন। তার কথায় বিশ্বাস করে অন্তত ৪০০ গ্রাহক অ্যাকাউন্ট খুলে সঞ্চয়ও করেছেন কোটি কোটি টাকা। সম্প্রতি কয়েকজন গ্রাহক তাদের প্রয়োজনে আলমগীরের কাছে সঞ্চয়কৃত টাকা ফেরত চাইলে তিনি টালবাহানা শুরু করেন। একপর্যায়ে তিনি এলাকা থেকে লাপাত্তা হয়ে যায়। এ ঘটনায় অনেকে স্থানীয় থানায় মামলাও করেছেন।
শুধু কিশোরগঞ্জ নয়, সম্প্রতি বাগেরহাটের যাত্রাপুর বাজারের ইসলামী ব্যাংকের এজেন্ট হাদিউজ্জামান হাদি দেড় কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছেন।
এ রকম আরও অনেক ঘটনা আছে যেগুলো এখনো জানাজানি হয়নি। এজেন্ট ব্যাংকের এজেন্টদের এমন অসাধু কর্মকাণ্ডে কঠিন ঝুঁকির মধ্যে পড়েছেন গ্রামাঞ্চলের সাধারণ গ্রাহকরা। অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়েছেন প্রতারণার শিকার হয়ে।
অপরদিকে, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, বিষয়টি তারা খতিয়ে দেখবেন।
এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, এটা আমাদের জানা নেই। তাই কিছু বলতে পারছি না। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক আমাদের গাইডলাইন অনুসরণ করে মনিটরিং করলেও এভাবে কোনো এজেন্টের টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, প্রত্যন্ত অঞ্চলে অতি সহজে ব্যাংকিং সেবা পৌছে দেওয়ার জন্যই গ্রাহক-এজেন্টের নিরাপত্তার স্বার্থে গাইডলাইন করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, গ্রাহকরা যাতে ব্যাংকে ঠিকমতো সঞ্চয়, ঋণ গ্রহণ ও রেমিট্যান্স জমা করতে পারে এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক গাইডলাইন তৈরি করে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ পর্যন্ত ৩১টি ব্যাংককে এজেন্ট ব্যাংকিং পরিচালনার অনুমোদন দিয়েছে। ‘গাইডলাইনস ফর এজেন্ট ব্যাংকিং অপারেশন ইন বাংলাদেশ’ নামে একটি গাইডলাইন তৈরি করে ব্যাংকগুলোকে দেওয়া হয়েছে। তাতে এজেন্ট ব্যাংকিং পরিচালনার বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এসব নির্দেশনার একটি হচ্ছে, লেনদেনে করতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশিত সময় মতো। ক্যাশ জমা ও উত্তোলন থেকে শুরু করে এজেন্টরা কি কাজ করতে পারবে আর কি করতে পারবে না সেটি উল্লেখ করে গাইডলাইনে বলা হয়েছে-কোনো ইউনিট ও মাস্টার এজেন্ট একাধিক ব্যাংকের এজেন্ট হতে পারবে না। বৈদশিক মুদ্রাও লেনদেন করতে পারবে না।
গাইডলাইন অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট ব্যাংক এজেন্টের সঙ্গে সব নিয়ম কানুন উল্লেখ করে চুক্তি করবে। যাতে গ্রাহকের স্বার্থ বিঘ্ন না হয়। গ্রাহকের তথ্য গোপন ও সংরক্ষিত রাখতে হবে। লেনদেনের চার্জ, ফি ও কমিশনও উল্লেখ করতে হবে চুক্তিপত্রে। কোনো এজেন্ট কার্যক্রম পরিচালনা করতে অপরাগতা প্রকাশ করলে ব্যাংককে তিন মাস আগে জানাতে হবে। নিয়মের অপব্যবহার হলে বাংলাদেশ ব্যাংক জরিমানা করতে পারবে।
নিয়ম অনুযায়ী কোনো গ্রাহক এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে টাকা জমা দিলে তার মোবাইলে মেসেজ যাবে। কিন্তু বিভিন্ন এজেন্ট ব্যাংকিং অফিসে ঘুরে দেখা গেছে সন্ধ্যার পরও ব্যাংকের জমা রশিদের মাধ্যমে গ্রাহকের টাকা জমা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু গ্রাহকের সেই টাকা এজেন্টের কাছে জমা হলেও গ্রাহক মেসেজ পান না। আবার কারও মোবাইলে মেসেজ গেলেও সেটি দেখে না গ্রাহক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইন অনুসরণ না করার কারণে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর নজরদারির অভাবে এ ধরনের অপরাধ ঘটছে। তাই মনিটরিং জোরদার না করলে প্রতারক এজেন্টরা আরও মরিয়া হয়ে উঠবে।
গ্রাহকের সঞ্চয় লুটের বিষয়ে জানতে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবুল কাশেম মো. শিরিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেন। তবে ব্যাংকের অন্য এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ ব্যাপারে মামলা হয়েছে। এখন আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আর ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মনি মাওলার এ প্রতিবেদককে বলেন, বাগেরহাটের ঘটনা জানা নেই। তাই কিছু বলতে পারছি না। তবে খবর নেব, কেন কীভাবে কোনো এজেন্ট সঞ্চয় তুলে নিয়েছে।
প্রসঙ্গত, অল্প সময় ও কম খরচে সহজে ব্যাংকিং সেবা দিতে এজেন্ট ব্যাংকিং ব্যবস্থার অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। গত এক দশকে এই এজেন্ট ব্যাংকিং জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ৩১টি ব্যাংকের ১৫ হাজারের বেশি এজেন্টের মাধ্যমে ১ কোটি ৭৫ লাখ অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। এসব অ্যাকাউন্টে ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি সঞ্চয় জমা হয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইন অনুসারে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো ঠিকমতো মনিটরিং বা নজরদারি না করার কারণে এক শ্রেণির অসাধু এজেন্ট গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে টাকা জমা না দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
এনএইচবি/এমএমএ/