হাতিরঝিল ভরাট ও পান্থকুঞ্জ পার্ক ধ্বংস বন্ধ করার আহ্বান
রাজধানীর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প শুরু থেকেই অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতার মধ্য দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের আইন, পরিকল্পনা ও যথাযথ পদ্ধতির তোয়াক্কা না করে হাতিরঝিলের জলাধার ভরাটের মাধ্যমে পরিবেশ ধ্বংস করেছে। কোনো ধরনের প্রভাব বিশ্লেষণ ছাড়াই নতুন করে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য পলাশী পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা হাতিরঝিল প্রকল্পের সার্বিক লক্ষ্য ও উপযোগিতাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করবে।
এই প্রক্রিয়া না থামানো গেলে পান্থকুঞ্জ পার্ক নষ্ট করার পাশাপাশি পলাশী পর্যন্ত বিদ্যমান রাস্তার উপযোগিতাও নষ্ট হবে। এই আয়োজনের মাধ্যমে শহর ধ্বংস করার যাবতীয় আয়োজন করা হয়েছে, যা অনতিবিলম্বে বন্ধ করা উচিত।
শনিবার (১৩ মে) অনলাইনে আয়োজিত ‘হাতিরঝিল, পান্থকুঞ্জ পার্ক এবং সংলগ্ন এলাকার উপর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পরিকল্পনাগত প্রভাব: ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক আলোচনায় বক্তারা এ সব কথা বলেন।
মূল প্রবন্ধে আইপিডি’র নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থার সাথে আলোচনা ও সমন্বয় না করেই এক্সপ্রেসওয়ের বিভিন্ন র্যাম্প নির্মাণ ও সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। কোনো ধরনের পরিকল্পনাগত প্রভাব বিশ্লেষণ ছাড়াই নতুন করে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের যেই এক্সটেনশন রাস্তা নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা হাতিরঝিল প্রকল্পকে ধ্বংস করবে।
তিনি আরও বলেন, হাতিরঝিলে প্রস্তাবিত ৪১ টি পিলার প্রকল্প এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জলাধারের পানিপ্রবাহ ও সার্বিক উপযোগিতা ধ্বংস করবে। জলাধার ভরাটের উদ্যোগ জলাধার সংরক্ষণ আইন ও বিভিন পরিকল্পনার সুস্পষ্ট লংঘন। পৃথিবীর উন্নত ও আধুনিক শহরগুলো নগর এলাকায় ফ্লাইওভারকেন্দ্রিক পরিবহন সমস্যা সমাধানের কৌশল থেকে সরে এসেছে। অথচ আমরা এখন পরিবহন সমস্যার সমাধান কৌশল হিসেবে নগর এলাকায় ফ্লাইওভারকেন্দ্রিক পরিবহন সমাধান পরিকল্পনা করে যাচ্ছি, যা ব্যক্তিগত গাড়িকে উৎসাহিত করে। হাতিরঝিল জলাধার ভরাট ও প্রকল্প সম্প্রসারণ বিষয়ে এক জরিপে নেতিবাচক মন্তব্য এসেছে শতকরা ৭১ ভাগ, ইতিবাচক ১৩ ভাগ, নিরপেক্ষ ৩ ভাগ ও অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য ১৩ ভাগ।
অনুষ্ঠানে আইপিডি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, বিশদ সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই হাতিরঝিলের জলাধার ভরাট ও পান্থকুঞ্জ পার্কের মধ্য দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে সম্প্রসারণ আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। ১৯৫৩ সালের টাউন ইম্প্রুভমেন্ট আইন অনুসারে রাজউকের অনুমতি ছাড়া কিংবা ডিটিসিএ'র সমন্বয় ছাড়া এ ধরনের প্রকল্প কীভাবে বাস্তবায়ন করা হয়, প্রশ্ন তোলেন তিনি। পরিবেশ ও নগর এলাকাকে ধ্বংস করে এ ধরনের প্রকল্পের সাথে যে সকল পেশাজীবী ও কর্মকর্তা যুক্ত থাকেন, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
আইপিডির পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশে যোগাযোগ ও পরিবহন অবকাঠামোর ক্ষেত্রে প্রকল্প গ্রহণের সিদ্ধান্ত আগে নেওয়া হয়। তারপর সেটাকে বৈধ করার জন্য সমীক্ষা বা সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। ব্যক্তিগত গাড়িতে ৫ শতাংশ লোক চলাচল করেন, তাদের জন্য বড় বড় মেগা প্রজেক্ট নেওয়া হয়। অথচ তার কুফল ভোগ করেন বাকি ৯৫ শতাংশ মানুষ।
স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকার ফুসফুস হাতিরঝিলকে মেরে ফেলবার আয়োজন করা হচ্ছে। এক্সপ্রেসওয়ের ৪১টি পিলার যেন হাতিরঝিলের বুকে ৪১টি পেরেক ঠুকবার আয়োজন করা হচ্ছে।
আইপিডির প্রস্তাব হলো—
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের মাধ্যমে জলাধার ভরাটের বিদ্যমান উদ্যোগ অনতিবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। ইতোমধ্যে জলাধার ভরাটের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আইন, পরিকল্পনা, যথাযথ সংস্থার অনুমতি ও পরিকল্পনা পদ্ধতির ব্যত্যয় ঘটে থাকলে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় তদন্তের মাধ্যমে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। হাতিরঝিলে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রস্তাবিত ৪১টি পিলার সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
এ ছাড়া পান্থকুঞ্জ পার্ককে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা ও দ্রুত সংস্কারের মাধ্যমে জনগণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। হাতিরঝিল থেকে পলাশী পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ের প্রস্তাবিত ফ্লাইওভার লিংক তৈরির প্রস্তাবনা বাতিল করতে হবে। অনুষ্ঠানে রাজধানীসহ দেশের যে কোনো পরিবহন প্রকল্প গ্রহণে আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক-পরিকল্পনাগত বাস্তবতায় পরিকল্পনা কৌশল গ্রহণ এবং প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করবার দাবি জানায় আইপিডি। ‘ঢাকা মহানগরীতে চলমান সড়ক, রেল ও নৌ পরিবহন অবকাঠামো সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য গঠিত কমিটি’কে জনস্বার্থ ও পরিবেশ রক্ষায় অনমনীয় ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।
জেডএ/আরএ/