অসময়ে বাণিজ্যিকভাবে আম চাষে উচ্চতর গবেষণা
আমের সঙ্গে রাজশাহীর নাম চলে আসে। গ্রীষ্মকালীন এ ফল আন্তর্জাতিক বাজারে এ অঞ্চলকে পরিচিত করেছে। ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছে আম। এখন শুধু একটি মৌসুম নয়, সারাবছরই আমের বাণিজ্যিক উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়ে চলছে উচ্চতর গবেষণা।
এরই মধ্যে বছরে তিনবার ফলন দেয় এমন বারি আম-১১ জাতটি উদ্ভাবিত হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের দীর্ঘ সময়ের গবেষণার পর জাতটি ২০১৫ সালে অবমুক্ত করা হয়। যদিও রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্র ২০১০ সাল থেকেই এ বিষয়ে গবেষণা করছে। স্থাপন করা হয়েছে ‘অফ-সিজন ম্যাংগো জার্মপ্লাজম’। তবে এরও আগে ২০০৫ সাল থেকে তিনবার ফল প্রদানকারী ‘বারমাসি’ নামে জাতের আম রাজশাহীতে চাষ শুরু হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর মতে, প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থায় অসময়ে আমের উৎপাদন বৃদ্ধিতে উচ্চতর গবেষণা চলছে। দীর্ঘ ১০ বছরের গবেষণার ফলে ‘বারমাসি’ জাতটির আম ‘টক স্বাদ’ থেকে মিষ্টি স্বাদযুক্ত বারি আম-১১ উদ্ভাবন করা হয়েছে। অসময়ে চাষ করা যায় এমন নতুন জাত সৃষ্টিতেও গবেষণা কার্যক্রম চলমান। তবে মৌসুমের চেয়ে অসময়ে আম চাষে ঝুঁকি বেশি হলেও লাভ অনেক বেশি। তাই কৃষকরাও আগ্রহী হচ্ছেন।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রে ‘অফ-সিজন ম্যাংগো জার্মপ্লাজম’ নামে গবেষণা প্লটে পাঁচজন গবেষক গবেষণাকার্য পরিচালনা করছেন। এরা হলেন-এম এ উদ্দিন, এমএইচ ওলিউল্লাহ, কেএইচ আলম, জিএমএম বারি ও এমওয়াই আবিদা। যারা বারি আম-১১ এর সঙ্গে কাজলা জামের পরাগায়ন করে নতুন জাত উদ্ভাবনসহ বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে মাঠপর্যায়ের গবেষণা করে যাচ্ছেন।
এ বিষয়ে রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলিম উদ্দিন বলেন, গবেষণাকার্য সম্পন্ন করে সরকারের অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত আমরা এ বিষয়ে কিছু বলতে পারি না। তবে এ পর্যন্ত এখানকার একটি গবেষণা শেষ পর্যায়ে। অনুমোদনের জন্য ঢাকায় পাঠানো হবে। সেখানে স্বীকৃতি পেলে নাম নির্ধারণ করে তা অবমুক্ত করা হবে। আর আফ-সিজন ম্যাংগো নিয়ে এখানে আরও বেশ কয়েকটি গবেষণা চলমান। অফ-সিজনে আমের নতুন জাত উদ্ভাবন করে বাণ্যিজিকভাবে চাষ বৃদ্ধিই গবেষণার লক্ষ্য।
রাজশাহী জেলায় মাঠ-পর্যায়ে অসময়ে আম চাষ নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করছেন রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (উদ্যান) উত্তম কুমার কবিরাজ। অসময়ে আম চাষে সমস্যা, সম্ভাবনা ও সমাধানের বিষয়ে তিনি জানান, বারি আম-১১ এর অনেক আগে বছরে তিনবার আম পাওয়া যায় এমন জাত রাজশাহীতে চাষ হয়েছে। যেটা ‘বারমাসি’ আম হিসেবেই পরিক্ষামূলকভাবে চাষিরা আবাদ করেছেন। তবে ওই আমটা খেতে টক ছিল। যার কারণে কৃষকরা ওই বারমাসি জাতটা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। তবে বারি আম-১১ এ জাতটির আম খেতে সুস্বাদু। এ আমের চাহিদাও ব্যাপক। কৃষকরা এ আমের চাষ করে ভালো লাভবান হচ্ছেন। রাজশাহীতে আনুমানিক ৫০ হেক্টর জমিতে এখন বারি আম-১১ চাষ করা হচ্ছে বলেও জানান এ কর্মকর্তা।
রোগবালাই ব্যবস্থাপনা বিষয়ে উত্তম কুমার কবিরাজ বলেন, বারি আম-১১ এ জাতের রোগবালাই আক্রমণের হার মৌসুমি আমের চেয়ে অনেক বেশি থাকে। সবচেয়ে বেশি থাকে পোকার আক্রমণের ঝুঁকি। কারণ মৌসুমে অনেক বাগান কিন্তু অফ-সিজনে অল্পসংখ্যক জমিতে এ জাতের চাষ হচ্ছে। এসময় সব পোকা এসে এ জাতটিকে আক্রমণ করে। এ কারণে কৃষক যদি সঠিক পরিচর্যা না করে তাহলে পুরো গাছের আম নষ্ট হয়ে যাবে। তবে এখন যারা এ জাতের আম চাষ করছেন তারা পরিচর্যার বিষয়ে সচেতন।
তিনি আরও বলেন, মৌসুমে একটি গাছে যে পরিমাণ আম পাওয়া যায়, বারি আম-১১ তিনবারে সেই আম দেয়। বাণ্যিজ্যিকভাবে এ আম আবাদের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা অফ-সিজিনে ১৬ হাজার টাকা মণ দরেও চাষিরা এ আম বিক্রি করেছেন। অথচ মৌসুমে অনেক সময় দেখা যায়, ১৬ মণ আম বিক্রি করেও চাষিরা ১৬ হাজার টাকা পান না। বারি আম-১১ চাষ সবচেয়ে বেশি লাভজনক।
উত্তম কুমার কবিরাজ বলেন, বীজ থেকে এ আমের চারা পাওয়া যায়। তবে ভালো ফলন ও সবল গাছ পেতে কলম পদ্ধতিতে পাওয়া চারা সবচেয়ে উৎকৃষ্ট। বারি আম-১১ জাতটি এখনও মৌসুমি চারার মতো সহজলভ্য হয়নি। বাণ্যিজিক বাগান তৈরিতে একসঙ্গে কেউ ১-২ হেক্টর জমির জন্য গাছের চারা চাইলে সেটা দেওয়া সম্ভব হয় না। তবে প্রতি বছরই চারা উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ছে। চাষিদেরও যথেষ্ট আগ্রহ আছে এ জাত নিয়ে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক খয়ের উদ্দিন মোল্লা জানান, অফ-সিজনের আম চাষ কৃষকদের কাছে জনপ্রিয় হচ্ছে। কারণ এটা লাভজনক। অফ-সিজনে আম চাষে পোকামাকড়ের আক্রমণের হার মৌসুমের তুলনায় বেশি থাকে। তবে এখন আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে পোকাসহ রোগ-বালাই ব্যবস্থাপনা মাঠ পর্যায়ের চাষিরা খুব ভালো বোঝে। তবে নতুন চাষিদের সচেতন থাকতে হবে।
এসএন